৯-ই জানুয়ারি। সারেগামাপার গ্র্যান্ড ফিনালে হচ্ছে
টিভিতে। এক বন্ধু মেসেজ করে বলল, “তোরা গাঙ্গুলি পরিবার একাই অনুষ্ঠানটার TRP তুলে
দিলি। ফুল ফ্যামিলি মিলে দেখেই চলেছিস সেই কবে থেকে।”
*****************************************
বিয়ের পর তিনটে জিনিষে সব থেকে বেশি
মন খারাপ হতো আমার।
১) পুরীর পথে জগন্নাথ এক্সপ্রেসের TT আমাদের টিকিট
চেক করছেন। বাকি তিনজনের পদবী ‘গঙ্গোপাধ্যায়’।
২) মা আর আমি গড়িহাটের (গড়িয়াহাট) অটোয়
বাড়ি ফিরছি। তারাতলায় এসে মা নামছে। আমার একটা পা প্রায় অটোর তলায় জীবনানন্দ হওয়ার
জোগাড়। সম্বিৎ ফিরল। আমিও ফিরলাম বেহালায়।
ভাই আর আমি কোথাও গেলে, ও যখন ওই গলিটায় ঢুকে যায়, পথের পাঁচালির
রেল গাড়ির দৃশ্যটা ভাসে আমার চোখের সামনে। দুই ভাই বোনের কাশবনের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য।
তারপর অপুর একা একা রেলগাড়ি দেখা।
৩) বিয়ের নেমন্তন্নের কার্ডগুলো। শ্রী বিশ্বজিৎ
গঙ্গোপাধ্যায় সপরিবার। খুব অবাক হতাম যখন মনে মনে আমি ভেবে ফেলেছি কি শাড়ি পরব আর
মা বলতো, ‘তোর নেমন্তন্ন নেই। মুখটা ওরম করিস না। বিয়ে হয়ে গেলে অনেকেই মেয়েদের
বলেনা। যা প্লেটের দাম!’ আবার মনে মনে শাড়িটা ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখতাম আমি। (আর
চারটে পান কম খাওয়া হবে সেই সিজেনে – এই ভেবে দুঃখে মূর্ছা যেতাম)।
********************************************
আমি শুরুতে সারেগামাপা খুব একটা দেখতাম না।
মহাভারত, জননী আর জন্মভূমির শুরুর গানটা যেমন নিজের
টিভি না চালিয়েও পাড়াপড়শিদের দৌলতে শোনা যেত, সারেগামাপাও ঠিক তেমনি। অন্যের টিভির
“অ্যালার্মে” বোঝা যেত এবার টিভি খোলবার পালা। এমনিতে টিভি দেখবার অভ্যাস না
থাকলেও, “সবাই বাড়ির দোর গোড়ায় বোতল ভরা বেগুনি জল ঝুলিয়ে রাখছে – আমিও ঝোলাব” এই
রকম একটা মনোভাব নিয়ে রিমোট হাতে বসে পড়তাম টিভির সামনে - সোম, মঙ্গল, বুধের মধ্যে
অন্তত একটা দিন।
তারপর একদিন আমার মেসো শ্বশুরমশাই ফোন করে খুব বকলেন,
আমি সারেগামাপা দেখছি না বলে। উনি যদি আমার শ্বশুরমশাই হতেন এবং আমরা এক বাড়িতে
থাকতাম, তাহলে আমাদের কথোপকথনটা হতো খানিক এরকম–
উনি- সারেগামাপা দেখছিলে না কেন?
আমি – একটা কাজ ছিল।
উনি - হেল উইথ ইয়উর কাজ। সারেগামাপাটা যে
আধ ঘন্টা হয়ে গেল, তুমি না দেখায় তাদের TRP কমে যে লোকশান হয়ে গেল, তার জন্য দায়ী হবে কে? তুমি?
আমি – দেবব্রত সেন, “পড়ম্পড়া” - এসব আমার
ভালো লাগে না। আর, সারেগামাপা
দেখাটাই জীবনের সব নয়।
উনি - ও তাই বুঝি বাড়িতে এসেও অফিসের কাজ
করে বেড়াও, লোকশানটা গায়ে লাগে না। Irresponsible! Worthless!
(বাথরুমে ঢুকে হাত মুছে এসে)
উনি - সারেগামাপা না দেখে তুমি কি করছিলে?
আমি – অফিসের কাজ করছিলাম।
উনি - কাজ! তুমি টিভি না দেখে কাজ কর?
Strange! সারেগামাপা না দেখে কেউ কাজ করতে পারে
এ আমার জানা ছিল না। তোমাকে আমাদের বাড়ির বউ বলে পরিচয় দিতে
আমার লজ্জা করে।
আমি - কি বলছেন আপনি?
উনি - হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক বলছি।
আমি - কাজ সম্বন্ধে এ ধারণা আপনার ভুল। সপ্তাহে
তিন দিন রোজ দেড়-দু’ ঘণ্টা সময় আপনি সারেগামাপা দেখে কাটাচ্ছেন। টিভি না দেখে কাজ করবার মতো মনের অবস্থা
আপনার নেই।
ঊনি - Really? তা এই সারেগামাপা-দেখা লোকটার শেলটারটি ছেড়ে কাজ সম্বন্ধে বড় বড় লেকচার দিলে ভালো হয়না?
আমি - তা হলে আপনি বলতে চান যে
সারেগামাপা না দেখলে আপনার শেলটারে থাকা চলবে না!
উনি - বলতে চান নয়। বলছি।
[ওপরের কথোপকথনটি কাল্পনিক হলেও, ওনার বকুনিটি একদম
আসল]
************************************************
আমি দেখলাম, যে কোন পারিবারিক ‘get-together’–এ, অধিকাংশ whatssap group-এ এবং চা
বা মদের আড্ডায় একটাই আলোচনা। সারেগামাপা। অনুষ্ঠান চলাকালীন, আমার দেওর মনে মনে দত্তক নিল অদ্রিজ আর সৌম্যকে, আমার ভাই
নিজের স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি দলিল করে লিখে দিয়েছিল দুর্নিবারের নামে, আমার এক বন্ধুর ভবিষ্যৎ বানী
– “দীপন ছাড়া কেউ জিতলে কান কেটে বাণের জলে দেব”…এই সবকিছু দেখে মনে হল, ‘ভদ্র সমাজে’
থাকতে হলে, সোম, মঙ্গল, বুধ সাড়ে নটায় টিভি খোলা
ছাড়া উপায় নেই।
চপ-মুড়ি-বেগুনি, ক্যারম বোর্ড, ক্লাবে আড্ডা, তাস,
অলি-পাবের গুলতানি, পিটার ক্যাট আর মোক্যাম্বোর বাইরে র্যাশন দোকানের লাইন দেওয়ার
মাঝে, বাঙ্গালিদের সন্ধ্যেবেলাগুলোকে নতুন একটা দিক দিয়েছে সারেগামাপা। আর আমায়
দিয়েছে বাবা, মা আর
ভাইয়ের সঙ্গে “একসাথে টিভি দেখার আনন্দ”...অন্য বাড়িতে থেকেও।
********************************************************
তারপর একদিন সারেগামাপা শেষ হয়ে গেল “all good things come to an end” –এর নিয়ম মেনে।
পুরীর চারটে টিকেটের একটায় অন্য পদবী,
মায়ের পাঁচটা স্টপেজ আগে নেমে যাওয়া আর বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্নে আমার নাম বাদ পরার দুঃখ কত সহজে ভরিয়ে
দিয়েছিল ওই একটা জিনিষ।
যেদিন সারেগামাপা শেষ হয়ে গেল, কি ভীষণ
কষ্ট হয়েছিল আমার। চোখের জল অসভ্যের মতো “আপন বেগে পাগল পারা” হয়ে আমার দুই গালে। সারেগামাপা শেষ
না হলে আমি বোধহয় কোন দিন বুঝতেই পারতাম না, যে একটা গোটা অনুষ্ঠান আমি গান শোনার
থেকেও বেশি করে দেখতাম ‘আমরা চারজন এক সঙ্গে টিভি দেখছি’-র লোভে।
************************************************************
সারেগামাপার চলে যাওয়ার রুদালি-দৃশ্যের যবনিকা পতন হল
“দাদাগিরি” নামক টিস্যু-বাক্সে।
‘আমরা চারজন এক সঙ্গে টিভি দেখছি’ (আলাদা বাড়িতে
থেকেও) – এটাকে জিয়িয়ে রাখছে “দাদা”। আমাদের নিউ আলিপুরের ঘরটা অদৃশ্য একটা অটোয়
চেপে, পাঁচটা স্টপেজ পেরিয়ে, কোন এক মন্ত্রবলে ধরা দিচ্ছে আমার কাছে। মনের কোন এক
কোণায় একটা বড় খাট রাখা আছে আমার (তাতে গড়িহাটের শিবানীর বেড কভার)। সেই খাটে বাবা,
মা, ভাই আর আমি সোম থেকে বুধ রাতে “দাদাগিরি” দেখি। এক সাথে।
*********************************
কত মহাপুরুষ জীবনের কত রকম মানে বলে দিয়ে গেছেন।
আমার কাছে জীবন মানে ...Zee বাংলা।