বাবা প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের দিন কলেজ স্ট্রিট যেত। (আমি জানি লেখার সময় নিজের বাবা-মাকেও 'আপনি' লিখতে হয়। কিন্তু তাতে আমার লেখার স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয় বলে, আমি সেটা করছি না) মা, ভাই আর আমিও যেতাম। তারপর বিয়ে হল। "আজ মেলেছি যে পাখনা" হল, সেই সঙ্গে ঢাকনা-বিহীন প্রেশারও। চাকরি, সংসার নিয়ে ল্যাজে-গোবরে হয়ে অনেক কিছুই জীবন থেকে বাদ যাওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু তাদের "যেতে নাহি দিব" পণ করে এখনো আটকে রাখতে পেরেছি ভেবে আনন্দে আঠ টুকরো হয়ে এখন ফেভিকুইক খুঁজছি।
এক চিলতে দোকান, এক চিলতে রোদ্দুরের মত। কি নেই? অঙ্ক নিয়ে কুইজ, নামকরণ সমগ্র, সেরা আবৃত্তির কবিতা সংগ্রহ, ছেলেদের মহাভারত আর সবার ওপরে, "সবার ওপরে" (প্রচ্ছদে সুচিত্রা সেন), অরিন্দম চক্রবর্তীর "ভাত কাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস" (১৪২০ সালের আনন্দ পুরস্কার-প্রাপ্ত, যেটা ঠিক আগের দিনই ঘোষিত হল) আর ওই যে লাল গয়নার বাক্স.....ওটা "পদি পিসির বর্মি বাক্স"। :)
বর্মি বাক্সের সঙ্গে মিষ্টির বাক্সও এলো। সেই সঙ্গে নতুন বিল-বইয়ে প্রথম বিল। আর উপরি-পাওনা: ঝকঝকে "আপনাদের-দিয়ে-বউনি-করলাম" হাসি। Priceless!
******************************************
বই পাড়ায় যে দুটো জিনিসের কথা না বললেই নয়। আপন মনে এই ছানাটির গনেশ-পুজো। চোখ আর কান দুটোই জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে। আমার নিজের তোলা ছবির মধ্যে পছন্দের তালিকায় এটা সব থেকে ওপরে।
১৪০০ সাল একুশে পা দিল। ওই বয়েসে আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম পরের বছর বিয়ে করব। তার মানে, বড় হয়ে গেছে ধরে নেওয়াই যায়। এবার একটু ভালো হয়ে থাকুক। এবং সবাইকে ভালো রাখুক। শুভ নববর্ষ।
পরশু বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায় সাত বছর পর কলেজ স্ট্রিট। পয়লা বৈশাখ এখন তো আগের মত নেই।ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ মানে সক্কাল সক্কাল পঙ্কজ সাহার দূরদর্শনের অনুষ্ঠান, একবার অন্তত দাদু-দিম্মার বাড়ি, নতুন 'বাড়িতে-পরার জামা' (কম দামি; পুজোর নতুন জামার থেকে অনেক কম দাম), সোনার দোকানের হাল খাতার মিষ্টির বাক্সে অমৃতি, লাড্ডু আর অম্বল-কচুরি বা চোঁয়া ঢেকুর-গজা, শিব-দুর্গার ছবি দেওয়া বড় এক পাতার ক্যালেন্ডার - যার মাসের পাতাগুলো হত সরু, নিচের দিকে.... এক পাতায় তিনটে মাস। তারিখগুলো সব নীল কালি দিয়ে লেখা, ছুটির দিন কমলা বা লাল দিয়ে আর পূর্ণিমা আর অমাবস্যায় চাঁদের ছবি আঁকা থাকত, তারিখ থাকত না। এইটা বলেই একটা কথা মনে পড়ে গেল।আমার ঠাকুমা তারিখের পাতাগুলো বছরের শেষে একসঙ্গে গুছিয়ে, মাঝখানটা মুড়ে, সুঁচ-সুতো দিয়ে সেলাই করে সাদা দিকটায় হিসেবের খাতা বানাতেন। পুরনো বছরের ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন বছরের হাল খাতা! (ডায়রি দিলেও উনি নিজের তৈরি খাতাতেই লিখতেন)। :)
আমাদের বাড়িতে ক্যালেন্ডারের চল কমে গেছে। পাখার হাওয়ায় সেটা ক্ষ্যাপা পেন্ডুলামের মত তাণ্ডব-নৃত্য করে আর দেয়ালের গায়ে গোল দাগ ফেলে দেয়। তাই বেচারির জায়গা রান্নাঘরের দরজার পেছনে। আমার শাশুড়ি-মা তো ঠাকুর-দেবতাকে নকুলদানা আর মিছরি খাইয়ে খাইয়ে ডায়াবেটিসের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তার থেকে রান্না ঘরই ভালো। ক্যালেন্ডারে বসে মাছ মাংসের ম-ম গন্ধে আরাম-দিনযাপন।
************************************
কলেজ স্ট্রিটে বোধহয় সবার একটা 'patent' দোকান থাকে। বাবার যেমন শৈব্যা পুস্তকালয়। (পুরনো, আউট-অফ-প্রিন্ট বা সেকেন্ড-হ্যান্ড, দুর্লভ বই এলেই ওনারা বাবাকে ফোন করেন বলে)
এক চিলতে দোকান, এক চিলতে রোদ্দুরের মত। কি নেই? অঙ্ক নিয়ে কুইজ, নামকরণ সমগ্র, সেরা আবৃত্তির কবিতা সংগ্রহ, ছেলেদের মহাভারত আর সবার ওপরে, "সবার ওপরে" (প্রচ্ছদে সুচিত্রা সেন), অরিন্দম চক্রবর্তীর "ভাত কাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস" (১৪২০ সালের আনন্দ পুরস্কার-প্রাপ্ত, যেটা ঠিক আগের দিনই ঘোষিত হল) আর ওই যে লাল গয়নার বাক্স.....ওটা "পদি পিসির বর্মি বাক্স"। :)
(পুনশ্চ: মা যখন কলেজে পড়ত, ওনার বাবার থেকে বই কিনত।)
"ও আমায় টাচ করবে না" মৃত্যুর পর জোলো হয়ে যায়। বুড়ো বয়েসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জনৈক ভদ্রলোকের সুচিত্রা সেনকে হাতে নিয়ে গদগদ হাসি ! :/
****************************************
রোদকে কাঁচকলা দেখিয়ে তিনজনের পায়ের তলায় সর্ষে-বাটা। বই পাড়ার অলি-গলি, সুখস্মৃতি, বই, মলাট, পুরনো বাড়ি, দিলখুশা, পুঁটিরাম দেখে "এখানে বাবা আর আমি কলেজ লাইফে কত খেয়েছি" শুনে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস: "আমরাও".......
ফুলের মশারি, তার মধ্যে বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদার নিশ্চিন্ত
গুটিসুটি।...
পড়াশোনা ~ এটা দেখেই মাধ্যমিক মনে পড়ে গেল! মার ধারণা ছিল
বাংলা মিডিয়াম স্কুলের পেপার শক্ত (এবং বেশি ভালো) হয় এবং সেগুলো সঠিক solve করা আর
আইনস্টাইন হওয়া মোটামুটি একই জিনিস।
এটাও তো ছোটবেলার স্মৃতি। কিলো দরে রুল-টানা বা সাদা পাতা কিনে আনত
বাবা কলেজ স্ট্রিট থেকে। সেটায় খুব ছোটবেলায় হাতের লেখা আর একটু বড়বেলায় অঙ্ক
প্রাকটিস করতাম আমরা!
মৌচাক এখনো বেরোয়! কিন্তু এখনকার কোনো বাচ্চাই কি সেটা পড়ে?
নববর্ষের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। কেনার আগে বেনীমাধব শীলের ছবি এবং
"R" চিহ্ন অবশ্যই দেখে নেবেন। গুপ্ত প্রেসের আবার হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া
আছে!
এখন তো বিয়ে বাড়ি ঠিক করে নিতে হয় বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে। সত্যি! বিয়ে
বাড়ির জায়গা পাওয়া আর ভগবানকে পাওয়ার মধ্যে দ্বিতীয়টা সোজা। তাই আগের বছর এই
পঞ্জিকা বেরোনোর আগেই গুপ্ত প্রেসকে ১০০ টাকা (ঘুষ) দিয়ে, পয়লা বৈশাখের
আগেই আমরা বিয়ের তারিখ গুলো জেনে নিয়েছিলাম। প্রতি মাসের তারিখ বাবদ ১০০ টাকা। হেল্পলাইন
নম্বরটা বোধহয় ওই কারণেই দেওয়া। :/
অনেকটা হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বাবা কালিকার ছবি তোলালো। "একি! এটা
তো বন্ধ। কেন আনলে এদ্দুর?" বাবার নির্লিপ্ত উত্তর, "ছবি তোলানোর
জন্য। ওটা বিকেলেই খোলে।" :০
মাকে জিজ্ঞেস করায়, মার জবাব: "কলেজ থেকে আমরা এই রাস্তা দিয়েই
হাঁটতাম; তখন কালিকার তেলে ভাজা কত খেয়েছি!"
আমাদের বংশটা প্রেম করে করে আর খেয়ে খেয়েই মরলো!
কি মন ভালো করা গেস্ট-লিস্ট! কতবার গেছি, ছবি তোলা হয়নি।...তাই।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: যদি 'জন্ডিস-বরফ' না নেন শরবতে, তবে ২ টাকা বেশি দিতে
হবে ) :D
নববর্ষ বই উৎসব, কলেজ স্কোয়ারে। সারি সারি বইয়ের স্টল, ২০% থেকে ৫০%
ছাড়। আহা! কিছু মানুষ সেসব দেখেও ছবি তোলার সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন।
"বাবা, তুমি কি মুকুল? হাসছ না কেন?"
এটা তার ফল -
সারি সারি বইয়ের মধ্যেও একজন "নীলু আর পিলু" বইটা দেখে
আনন্দে আত্মহারা। (নীল আমার ভাইয়ের নাম)। ছেলেকে ২৪x৭ মিস করার জন্য যদি টাকা
দেওয়া হত, আমার মার নাম affidavit করে পাল্টে রাখা হত - ধীরুভাই আম্বানি।
পেট-পুজো - স্বাধীন ভারত আদর্শ হিন্দু হোটেল।(নিরানব্বই বছর বয়েস; ভবানী দত্ত লেন; নেতাজিও নাকি এখানে খেয়েছেন) মাটির ভাঁড়ে জল, কলাপাতায় খাওয়া, ডিউস বলের সাইজের মাছের ডিমের বড়া (যেটা আমার বিশ্বাস, তিমি মাছের ডিম), শুধু মাত্র 'taste' করার জন্য পুঁই শাক আর মাছের মাথার তরকারি জোর করে, সযত্নে দিয়ে যাওয়া, প্রত্যেক ওয়েটারের কানে গোঁজা chalk আর সেটা দিয়ে টেবেলের ওপর হিসেব লেখা.......সব মিলিয়ে স্বর্গ-সুখ ।
পান intended -
এই দোকানটার ব্যাপারে লিখবনা; এটা নিজে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে
হবে। ৫০১ থেকে ৫ টাকা সব রকমের পান আছে। কিন্তু যেটা পাগল করে দেয় সেটা হলো,
ওদের সারা দেওয়ালে বাঁধানো প্রশংসা পত্র। ইন্দিরা গান্ধী থেকে পদ্মজা নাইডু,
সর্বপল্লী রাধা কৃষ্ণনন থেকে বিধান রায়, ভানু বন্দোপাধ্যায় থেকে মান্না দে....কত
লোকের যে নিজের হাতে লেখা গুনগান! তাক লেগে যাবে।
বই পাড়ায় যে দুটো জিনিসের কথা না বললেই নয়। আপন মনে এই ছানাটির গনেশ-পুজো। চোখ আর কান দুটোই জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে। আমার নিজের তোলা ছবির মধ্যে পছন্দের তালিকায় এটা সব থেকে ওপরে।
আর এই ছবিটাও। গিজগিজে ভিড়ে কলেজ স্ট্রিট। বাংলায় লেখা
নেম প্লেট দেখতে পেয়ে একটা illogical আনন্দ হলো ঠিকই, কিন্তু মন ভরে গেল অন্য
একটা কারণে। একটা পুরনো ইন্টারভিউতে জোহরা সেগাল বলেছিলেন:
"Life, this endless conversation with yourself
Silent, in sanity, audible in madness...."
কথাগুলো যেন এই ছবিটার জন্যই বলা.....
**************************
অনেক ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরে, আরাম করে,
মায়ের গায়ে ঢলে পরে যখন ছবিগুলো দেখছি, তখন একটা জিনিস মনে হল....অনেক কিছু
পাল্টালেও কিছু জিনিস একদম একই রয়ে গেছে নববর্ষের প্রথম দিনের।
মিষ্টি - কেকের সাইজের মিঠাই :)
বাংলা ক্যালেন্ডার - এটা আজীবন সযত্নে তুলে রাখার
মত একটা। প্রতিটি মাসে পশ্চিম বাংলায় যা মেলা বা উৎসব হয়, তার ফিরিস্তি। CESC
এত ভালো ক্যালেন্ডার করে জানলে কোনদিন গয়নার দোকানে ছুটতাম না. :(
নতুন জামা- ভাইয়ের দেওয়া টি-শার্ট। দেখেই গলা ভার,
আনন্দে।
ছন্দপতন: "একটু বড় সাইজ আছে, জয়দীপও পরতে
পারবে। লোকে ভাববে মমতা ব্যানার্জীর রেল-মন্ত্রী হওয়ার ক্যাম্পেন!"
:D উপহার পেয়ে ঠিকঠাক করে যে সেন্টু
খাব, তারও উপায় নেই।