Tuesday 30 October 2012

শহরে পুজো, পুজোয় শহর


 রিকশা থেকে নেমে দশ টাকা দিয়ে চলে যেতে গিয়ে পিছু-ডাক.... "দিদি, তিন টাকা ফেরত পাবেন.." 
"
না আসলে পুজোর কটাদিন তো দশ টাকাই..."
"
পুজো তো শেষ, দিদি"..

শুনেই গলা ব্যথা...
আর এই গলা ব্যথাটা যেন যেতেই চায়না...জল খাই, ঢোক গিলি...তাও :(
প্রতি বার পুজোর পর এমনটা হয়.. কি মুশকিল!

অগাস্ট মাস পড়তে না পড়তেই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, পেটে কাতুকুতু, কি পরবো, কোন দিন কোনটা, কি খাবকোথায় এবং কি ভাবে pose দিয়ে ছবি তুলবকাজের মেয়েকে কত টাকা "পুজোর Bonus" দেবনতুন পর্দা কিনবো কিনা...এসব নিয়ে কত্তো পরিকল্পনা, তোড়জোড়.....তারপর হুট করে সব শেষ...

*****************************

"এই, পুজোর 'টা শাড়ি হলো রে?"
"কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখবি?"
"আমার দর্জিটা ঝোলাবে দেখিস..ষষ্ঠীর দিন দেবে বলেছে!!!"
"কি ঘ্যামা প্যান্ডেলএশিয়ান পেইন্টস পাবেই মনে হচ্ছে"
"পিটার ক্যাট- কেউ পুজোয় খায়সারা বছর খেতে পাস না?? পুজোর ভোগের চেয়েও বড় লাইন...আজ যা না, কাল ঢুকবি "
"রোজ মদ খাব..রোজ...আচ্ছা সপ্তমী রাতটা বাদ দিয়ে কিন্তু...পরের দিন সক্কাল বেলা অঞ্জলি.. hangover থাকলে চাপ..."
"নর্থটা কবে করবি?"
"পুজোর পর ছুটি নিচ্ছি বলে boss যা বাঁশ দিল 'দিনএকটা গোটা প্যান্ডেল হয়ে যাবে"
"Bluetooth অন করছি...ঢাকের রিং টোনটা দে"
"ঠাকুরের চোখটা দেখলি? পুরো স্বস্তিকা.....ফিগারটাও!"
"Theme বুঝিনা বাপু, ঠাকুর মানে রমেশ পাল বা মোহনবাঁশি রুদ্র পাল...কি সেই মুখআর এখন?? ছিঃ ! "
"প্রাইজ পাবার লোভে রবীন্দ্রসঙ্গীতটা আবার বাজছে দেখছি পুজোগুলোতে "
"তিন বার করে ফুল দেওয়া যাবেনা, একবার বেশি করে নিয়ে তিন ভাগে ছুড়বেন...ভক্তিটাই সব, বুঝলেন মাসিমা?" (অঞ্জলির সময়)
"কাকু, এবার দশমীর ভোগ হলো পোলাও-মাংস, চাঁদাটা কিন্তু বাড়াতেই হবে  "


আর এটাও..
অনু বা মিনু শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে জনৈক ভদ্রলোকের উক্তি: "পুজোয় চাই নতুন শাড়ি?"
আমি: "আর চাই প্রচুর ঝারি"
"আমার চাই নতুন নারী"
আমি: "কথা বলব নাযা...আড়ি"

পুজো মানে আদিখ্যেতাও... :)
****************************************
অনেক হয়েছে  এবার মন খারাপের কথা বলিশরতের আকাশটাই  culprit ..তার ওপর পুজো....রোজ ঘুম ভাঙছে ঢাকের বা মাইকে মন্ত্রপাঠের আওয়াজে.....হুট করে একদিন আবার সেই ফোনের এলার্মে ঘুম ভাঙ্গা ! মনের আর কি দোষ?

মা ছোটবেলায় বলতো, "কষ্ট হলে সব সময় ভাববি, আমার চেয়েও কেউ কষ্টে আছে"....ভীষণ বোকা কথা এটাতবুও কেন জানি না আমি এটা শিখে গেলাম মায়ের থেকে.... মানে, মায়ের একটাও ভালো গুণ আমি পাই নি...এটা ছাড়া
 
আবার বলছি, বোকা হলেও ব্যাপারটা ভালো..."আমার চেয়েও কেউ কষ্টে আছে"...

যেমন শহরটা...এই কলকাতা শহরটা...
*******************************************************
ছাতিম ফুলের গন্ধে আমি বিভোর হয়ে যাই...শিউলির গন্ধেও ..
ট্রাফিক সিগনালে "বাজলো তোমার আলোর বেণুশুনে মনখারাপ...
মা নেই কলকাতায় এবার পুজোয়, তাতেও
আর ওই আকাশটা দেখেও...
গানের ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের শরতের গানসেটা শুনেও..
"...আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসেরহে না আবাসে মন হায়,
কোন কুসুমের আশে, কোন ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় গো...
 কি জানি পরাণ কি যে চায়...."

আর এই সব কিছুর মধ্যে একটাই কথা মনে হলো.. "আমার চেয়েও কেউ কষ্টে আছে"...

কলকাতা...

বিয়ের সব অনুষ্ঠান, হই-হট্টগোল শেষ হয়ে যাবার পর মেয়ের মনের অবস্থা কেমন হয়? ঠিক তেমন
বিয়ের দিন পর যখন আমাদের ছাদ থেকে মেরাপ খুলে নেওয়া হলো বা টুনি লাইটগুলো, ঠিক এমনটাই হয়েছিল আমার
সানাইয়ের শব্দের জায়গায় সেই ফোনে দেওয়া এলার্মে ঘুম ভাঙ্গা!!!

তাহলে শহরেরই বা হবে না কেন ?

চারটে ছাতিম গাছের গন্ধে আমি নাকি বিভোর!
পাঁচটা সিগনালে গানের সুর আমার মন উদাস করিয়ে দেয়??
'টা শিউলি হয় আমাদের উঠোনের গাছটায়?
মা তো প্রতিবার পুজোয় থাকে
কতটুকু আকাশ দেখা যায় আমার ছাদ থেকে?

তখন ভাবি কলকাতার কথা  ওপর দিকে তাকালে ইয়া বিশাল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত মেঘ শরতের আকাশ, basically .
চারশো খানা ছাতিম গাছ শরীর জুড়ে..
পাঁচশোটা সিগনালে হয়তো একসঙ্গে বাজছে পুজোর সুর
লক্ষ লক্ষ শিউলি ঢেকে আছে শরীরের বিভিন্ন অংশ...
ঢাকের আওয়াজ, শ্যামল মিত্র বা অখিলবন্ধু বাজছে কানে...সারাদিন
বিরিয়ানি থেকে শুরু করে তেলেভাজার গন্ধ নাকে-মুখে, দিনরাত
নাগরদোলায় মাথা ঘোরা  
বলা বাহুল্যকি ভীষণ সাজ সেই সঙ্গে...
কত কত ছবি তোলা..
কত আলো ..
প্রিয়জনের ঘরে ফেরা..
"ঠিক কি করলে তাকে আটকে রাখা যায়"...ভেবে ভেবে ঘুম-না-হওয়া রাত কাটানো...
ঠাকুর দেখেও 

তারপর দশমী
কলকাতার মন খারাপ আমি জানি
বিয়ের পর ছাদের মেরাপ খুলে নেবার মত  এত আলো, এত সাজগোজ সবের ইতি.. কাল থেকে আর ঢাকের শব্দ নেই, সিগনাল বা মাইকে পুজোর গান...নাহতাও নেই   চারিদিকে খাবারের বা খুশির গন্ধ...তাও আর থাকবেনা   শিউলির season গেল বলে...
ছবি তুলবে কেউ এত এতনা তো!
আর চলে যাওয়া...প্রিয়জনও চলে যাবে...যেতে হয় তাই 

তার ওপর, মাথা তুললেই অতখানি আকাশ দেখলে কারো মন ঠিক থাকে?

বেচারা   কলকাতাটা :(
 
"আমার চেয়েও যে কষ্টে আছে"...
***********************************

আগে কখনো এইভাবে ভাবিনি আমি...কলকাতার জন্য   ভাবলে বেশ ২০-২৫টা বছর "শরতের মনখারাপ নিয়ে রচনা লেখ ৫০০ শব্দে" - এই অবস্থাটা হত না, আর কি 

এখন যেমন মনখারাপটা চলে গেল..

মনে হলোবিজয়ার পর কোলাকুলি বা বড়দের আদরে কত মনখারাপ কেটে যায়...শহরটার তো সেটাও নেই   জড়িয়ে ধরার লোক   আহারে

আর এত কিছুর মধ্যে এটাও বুঝলাম যে এত unconditionally , এত selflessly আমি বোধহয় খুব কম ভালবেসেছি
এই শহরের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই
"পরমা, তোকে ভীষণ ভালবাসিবলা নেই..
পুজোর বোনাস!  নাহ, সেই সম্পর্কও না
" স্বাদের ভাগ হবেনা" - মার্কা হিংসে নেই  
"পুজোয় চাই নতুন নারী" বলে আড়ি নেই

তবুও কেন?
***********************************

কারণ হলো,  "আমি আছি, কোনদিন যাব না
এটাই যথেষ্ট 
ভেবে দেখলাম, এই একজন কোনদিন ছেড়ে যাবে না   যায় না
 
মানুষ শহর ছাড়ে...শহর মানুষকে ছাড়ে না
ঝগড়াবিচ্ছেদ, মৃত্যু ....কোনটাই স্পর্শ করে না শহরের সঙ্গে সম্পর্কটাকে....কোনদিন

তখন কি ভীষণ আনন্দ হলো আমার! একদম "গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায়  ঘোর" - টাইপের আনন্দ
আর মনে হলো, যদি শহরটাকে জড়িয়ে ধরে বলা যেত একবার..."আমি আছিকোনদিন যাবনা"...

***************************

জড়িয়ে ধরা বলতে মনে পড়ল, অনেক কোলাকুলি, অনেক ভালবাসা, প্রণাম, শুভেচ্ছা...
শুভ বিজয়া....