Monday, 21 July 2014

নদীর ওপার


“শেষ দিনটা কেমন ছিল পুরনো অফিসে?” – প্রশ্নের মধ্যে লুকনো ‘চুপ করে কেন, একি বেলা! তুমি কাঁদছ?’

চোখ পিটপিট করলাম, ওপর দিকে তাকালাম, জলের বোতলে ঢক ঢক করনে লাগা। কিন্তু চোখের জল আর দরদ দুটোই উথলে নদী আপন বেগে পাগল পারা। “সাধে বলি, তোর favourite হলিডে স্পট নদীর ওপার? খবরদার মন খারাপ করবি না।”

মন খারাপের সুইচ বোর্ডটার কাছে বেশির ভাগ সময়ই আমার বয়েস পাঁচ। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে লম্বা হওয়ার চেষ্টা, তবুও সুইচে হাত পৌঁছয় না। শেষে রুলার বা হাত-পাখার পেছন দিকটা দিয়ে আলো জ্বালানো।

মন খারাপ হল ছোট বেলার সুইচ বোর্ড। ইচ্ছে মত কি আর বন্ধ করা যায়?

**********

বাবা ভাবতো ফক্স অ্যান্ড মণ্ডল থেকেই বোধহয় আমি রিটায়ার করব। এত ভাল জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আর রেল লাইনে গলা দেওয়া....এই দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টা ঢের ভাল। বাবাকে খুব খুব অবাক করে আমি পুরনো অফিস ছেড়ে দিলাম একদিন।

আজকালকার দিনে চাকরি ছাড়া কোন বড় ব্যাপার নয়। এরম লোক চিনি যারা বছরে দুবার চাকরি বদল করেছে। এই যুগে তাদের পাশে আমি আলিপুর চিড়িয়াখানার “অদ্বৈত”। সেই জন্যেই গলা ভার আর চাপা আনন্দ। আর বেশ খানিকটা আদেখলামি। (নতুন অফিস যাব বলে আমার মেসো-শ্বশুর নতুন জামা কিনে দিয়েছেন, বাবারা ব্যাগ আর পেন। এমনি এমনি শেষের শব্দটা লিখিনি!)

*******************

এক মাসের বেশিই হয়ে গেছে ওই পাড়া, ওই অফিস ছেড়েছি আমি। তবুও, এখনও, বিয়ের ঠিক পর পর গড়িয়াহাট থেকে অটোয় ফেরার দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। নিউ আলিপুরে পৌঁছে অটোওয়ালা বলতেন, “আপনার স্টপেজ এসে গেছে, দিদি।” আমার সম্বিত ফিরত। বলতাম, “না বেহালায় যাব তো!” উত্তরে শুনতাম, আমি নাকি অটোয় ওঠার সময় নিউ আলিপুর বলেছি।

এই ভুল যে কতদিন করেছি মনে নেই। যখন লজ্জা করত, মাকে মনে পড়তো। মা এখনও মাঝে মাঝে আমার বাপের বাড়ি আসা প্রসঙ্গে বলে, “ফুলবাগানে কখন আসবি?” কিছু অভ্যেস বিছানার চাদরে নেল পালিশের দাগ। উঠতেই চায় না।

আমি এখনও মাঝে মাঝে “আমাদের অফিস” বলে পুরনো অফিসটাকে বোঝাই। আর তখন নতুন কলিগদের সামনে কি পরিমাণ অপ্রস্তুত হই কি বলবো! এই ভুলে এত বার জিভ কেটেছি, যে কালি ঠাকুর কম্পিটিশনে নামলে, খুব বাজে ভাবে হেরে মনোজ কুমারের মতো মুখ লুকোতেন।
আসলে অভ্যেস। বদ অভ্যেসও বলা যেতে পারে।

*************

নতুন চাকরি পাওয়ার আনন্দ খানিকটা হয়েছে সেটা সত্যি। টাকা পয়সা মন্দ না, কর্তার অফিস থেকে ঢিল ডিউস বল-ছোঁড়া দূরত্ব, শনিবার ছুটি। অনেকগুলো নারকোলের পুর-ভরা পাটিসাপটার মধ্যে হঠাৎ একটা ক্ষীরের। ভাল খারাপ জানি না। স্বাদ বদল তো বটেই।

নতুন অফিসের প্রথম সপ্তাহের শেষে, ও জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগছে তোর নতুন অফিস?”
-      
   -অন্যরকম।

“কিরকম অন্যরকম শুনি” ...
-     
   - প্রথম যেদিন ঝালমুড়ি আনালাম, খুব অস্বস্তি হল। হাই কোর্ট পাড়ার মুড়ি মানেই cause list-এর পাতা দিয়ে বানানো ঠোঙা। সেটায় চোখ সোয়ে গেছে। অন্য প্রিন্টের পাতা দেখে কিরম অদ্ভুত লাগছিল!












“এটাতেও খাওয়া টেনে আনলি? আর?”
-    
-      - এখানে মাটির ভাঁড়ে চা পাওয়া যায়না। CCD-র মেশিন আছে। চা ভাল। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুলতানি আর চা শেষ হয়ে গেলে ভাঁড়ের ধারগুলোয় দাঁত বসানোটা নেই।












“আর?”  

-     -  কুকি জার, ফ্রেঞ্চ লোফ আছে। কিন্তু Bakery বিস্কুট আর বাপুজি কেক নেই।

“পুরো নদীর-ওপার syndrome রে। নেই নেই করে গলা শুকনো! পেটুক কোথাকার! কি আছে সেটা বল?”

-      - ক্ষেতে ফসল আছে, গাছে ফুল আছে, ফল আছে, পাখি আছে...শান্তি আছে, সুখ আছে। *চিন্ময় রায়ের মতো করে*

এর পর আর কথা এগোয় না। এক রাশ হাসি দমকা হওয়ার মতো এসে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে আর সব এলোমেলো করে দেয়।

****************








ফুল আছে, ফল আছে বলতে মনে পড়ল। এই অফিস শুরু হয় দেরীতে। কর্তাকে অফিস পৌঁছে আমার দু’হাত ভরতি সময় থাকে। ওই সময়টা আমার নিজের। একদম নিজের। মেট্রোরেল-জীবনে কিছুক্ষণের জন্য ট্রাম কোম্পানির সুখ। বই পড়ি, হেঁটে চারিদিক ঘুরে বেড়াই, ছবি তুলি, কোন নতুন কাফে চোখে পড়লে গলা ভিজিয়ে আসি, বেল ভিউএর লেকটার ধারে বসে মাছ আর মানুষ দেখি অপলক। এর মধ্যে সবথেকে আনন্দের জিনিসটা হল নানান গাছপালা আর ফুল চেনা। গাছ দেখলেই আমার এই বাড়ির বাবার কথা মনে হয়। বাজার থেকে বাবা ফিরেছে; আমার কৌতূহলঃ ‘কি কিনে আনলে?’ উত্তরঃ ‘মায়ের হরলিক্স, মুড়ি আর দুটো গাছ।’ এক রাশ অক্সিজেন ভরা একটা উত্তর।








আর একজনের কথাও মনে পড়ে। আমার এক দিদি। শিলিগুড়িতে থাকে। খুব গাছ ভালবাসে। বেশির ভাগ ছবিই তার জন্য তোলা। এরম একদিন ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো কদম গাছ। খুব একটা দেখি না তো আজকাল, তাই অদ্ভুত আনন্দ হল। উপরি পাওনাঃ মাটিতে দুটো ফুল পড়েছিল। হাতে নিয়েই ভাইয়ের কথা মনে হল। ছোটবেলায়, স্কুলে পড়তে মা ওকে কতবার এভাবে চুল কাটিয়ে দিয়েছে!













আমার অফিসে ঢোকার মুখে এই গাছটা আছে। কাঠগোলাপ এমনিতে ডিমের পোচ। সাদা-হলুদ। কিন্তু এটা ক্যান্ডিফ্লস। বুড়িমার মিষ্টি চুলের মতো মন ভাল করা গোলাপি আভা।

পূর্ণেন্দু পত্রির একটা কবিতা পড়েছিলাম। সেটা খানিক এরমঃ
“তবে কলকাতার এখন ডায়াবেটিস।
কলকাতার ইউরিনে এখন বিরানব্বই পার্সেনট সুগার।
কলকাতার গলব্লাডারে ডাঁই ডাঁই পাথর।
গাছপালা খেয়ে আগের মতো হজম করতে পারেনা বলে
কলকাতা এখন মানুষ খায়...।”

সত্যি হয়তো গাছপালা খেলে গুরুপাক হয় শহরের। কারণ, আমার যাওয়া-আসার পথে এখনও প্রচুর সবুজ দেখতে পাই।

আগের অফিসের দুদিক দিয়ে শুধুই বাড়ি। গাছ বলতে, পুরনো বাড়ির ইটের পাঁজর ফুঁড়ে সবুজ বিপ্লব। এখানে একটা বড় জানলা আছে। অনেকখানি আকাশ আর অনেকখানি সবুজ দেখা যায় জানলার পাশে দাঁড়ালে।




আর ছাদে উঠলে দেখা যায় ফ্লাই ওভার।




*******************

নতুন কাজের জায়গা নিয়ে নানান বলছি যখন, তখন এটা না বললেই নয়। এই প্রফেশন আমার কাছে খানিকটা prostitution এর মতো। মাইনে নেব, কাজ করব। সোজা হিসেব। প্যাশন নেই। “A woman can fake orgasms”– এর নিয়ম মেনে, ভাল কাজ হলে, বড় ডিল সাইন হলে খুশিও হবো। এই ল ফার্মটি যদি জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেয়, কলারটা কান অবধি তুলে, শিষ দিতে দিতে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু ওইটুকুই। কাজে ঝাঁপ দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হবো, এরম ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনটাই আমার নেই। তাই কাজের থেকে কাজের জায়গায় লোকজন কেমন, পরিবেশ কেমন সেটা নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক বেশি।

এই অফিসে লোকজন দারুণ এটা বলার সময় হয়তো আসেনি। কিন্তু একটা ঘটনা না বললে অন্যায় হবে।

হাই কোর্ট পাড়ায় কত ভালো খাবার পাওয়া যায়...এই গল্প ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো আমি বাজাতাম প্রথম ক’দিন। দ্বিতীয় সপ্তাহে এক সহকর্মী আমায় cause list দিয়ে বানানো একটা ঠোঙ্গা দিল। তাতে টেম্পল চেম্বারের (আমরা বলতাম ছ’নম্বর) শিঙ্গাড়া! খয়েরি পুরে ঠাসা ‘হিন্দুস্তানি দোকানের’ শিঙ্গাড়া। কেউ এত কম আলাপে, মনে রেখে এটা করতে পারে, আমি সত্যিই ভাবিনি। “Kya kahoon mein apse doston…meri toh aankh bhhar ayi hein *Satyameva Jayate-তে আমির খানের মতো গলা করে*

*******************

এটা বলতে গিয়ে মন আবার ফ্ল্যাশ ব্যাক মোডে। আগের অফিসের এক দাদা মিটিং ফেরত নাহুমসের দেড় টাকা দামের মটন শিঙ্গাড়া আনত আমাদের জন্য। সঙ্গে ব্রাউনি। রামজানের সময় আলিয়া থেকে হালিম!

আর একজন অফিসের কাজে দিল্লি গেলেই, রাশি রাশি শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু আর লোশন।
পাঁচ তারা হোটেলের এই শাওয়ার জেলগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সাবান গায়ে মাখার পর জল দিয়ে ধুলে খুব সহজে চলে যায়। কিন্তু এগুলো অনেক ধোওয়ার পরও কেমন যেন গায়ে লেগে থাকে।

ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা লেখায় উনি বলেছিলেন, যে লেসার অপারেসানে চোখের দৃষ্টি সংশোধন করানোর পর উনি আর চশমা পরতেন না। প্রথম প্রথম মনে হত যেন জামা কাপড় না পড়ে বাড়ি থেকে বেরছেন। চশমায় এতটাই অভ্যস্ত উনি। নানান মুহূর্তে অতর্কিতে ওঁর হাত চলে যেত চশমার জায়গায়। তাই শেষে উনি লিখলেন...

“আমি এখনও চশমা পরি।
মনে মনে।”
  
বিয়ের পর বাঁ হাতে লোহা পরতাম বলে, ঘড়িটার হাত বদল হল। বহুদিন অবধি সময় দেখতে গেলে বাঁ হাতটা উঠে আসতো।

এটা বোধহয় স্বাভাবিক। ঘড়ি, চশমা ছাড়াও আর অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

এমনকি কাজের জায়গাতেও। 

15 comments:

  1. Injirite bangla likhi ge.

    boroi shundor likhish tui. Eta porar por Nahoum's er Cheese Sambusa er kotha mone pore gelo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you! Uff cheese sambusa....jibhe Niagra ar khider viagra. Ki jinish bolli!

      Delete
  2. Boddo bhalo lekha. Darun laglo. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. বড্ড খুশি হলাম....:)

      Delete
  3. arektu hoile mondo hoito na............. toast butter...... haser dim sedhho with morich.... amader stock e haldiram etc... parking lot er jontrona totsoho khichuri........

    church lane er telebhaja 2008-2010 bikele roj...... floatel..... amber..........mobile hariye new market theke uddar

    ReplyDelete
  4. Ha ha. Ei smritir mono tulona hoyna. High court parar khwawa dawa niye likhle mahakabyo.

    ReplyDelete
  5. দারুন সুন্দর হয়েছে এটুকু বলতে গিয়েও কোথায় যেন একটা নীরব ব্যথার আঁচ পেলাম, এই পেশায় এতদিন কাটিয়ে অনেক আসা যাওয়া দেখলাম। দেখাটা অভ্যাসে দাড়িয়ে গ্যাছে, কিন্তু দুজনের চলে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। কোথাও যেন এক আত্মীয়তার বাঁধনে বাঁধা ছিলাম তথাকথিত রক্তের সম্পর্ক না থেকেও, আর তাই তাদের না থাকাটাকে আজ অবধি অভ্যাস করে উঠতে পারিনি। ছবি ও নামকরণ দুটই অসাধারন লেগেছে।

    ReplyDelete
  6. I cannot read bengali. I was intrigued at mention of cheese sambousa. Are there other item names of Nahoums listed ?

    ReplyDelete
  7. Parama tomar lekhar fan hoyechi.khub sundor.

    ReplyDelete